শিরোনাম

নারীর প্রতি সহিংসতা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেলেও বাস্তবায়নে অগ্রগতি নেই


নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ, ২০২৪ উদযাপন উপলক্ষে জেন্ডার প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ এর উদ্যোগে আজ ৯ ডিসেম্বর, সোমবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে জেন্ডার প্ল্যাটফর্মের পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেনে সবুজের অভিযান এর নির্বাহী পরিচালক  মাহমুদা বেগম। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন আওয়াজ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক নাজমা আক্তার, বিলস এর পরিচালক নাজমা ইয়াসমীন, বিএনডব্লিউএলএ’র উপ-পরিচালক নিঘাত সীমা, সলিডারিটি সেন্টারের সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার অনিন্দিতা ঘোষ, কর্মজীবী নারীর প্রকল্প সমন্বয়কারী দীপা আক্তার, প্রমুখ।

প্ল্যাটফর্ম এর পক্ষ থেকে উল্লেখ করা হয়, স্বাধীনতা-পরবর্তী পাঁচ দশকে বাংলাদেশের নারীদের জীবনমানে ব্যাপক পরিবর্তন এলেও নারী নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন, শ্লীলতাহানি, ইভটিজিং এবং ধর্ষণ-গণধর্ষণসহ নারীদের প্রতি সহিংসতামূলক কর্মকান্ডের ক্ষেত্রে ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন আসছে না, বরং এখন নারীর প্রতি সহিংসতার হার উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। গণপরিবহণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল, এমনকি অনেক নারী নিজের পরিবারেও সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।

সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করা হয়, “নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০”, “বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬” ইত্যাদি থাকা সত্ত্বেও কেন কর্মক্ষেত্রে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে পৃথক আইন প্রয়োজন সে বিষয়ে মহামান্য হাইকোর্ট তার রায়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন। মহামান্য হাইকোর্টের এ রায়ে নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে যে, কোর্টের এই আদেশ ও নির্দেশনাগুলো জাতীয় সংসদ কর্তৃক এ বিষয়ে পর্যাপ্ত ও কার্যকর আইন প্রণিত না হওয়া পর্যন্ত অনুসৃত ও পরিপালিত হবে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ্য করা যায়, একদিকে যেমন মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশ মত কর্মক্ষেত্রে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোন আইন পাশ হয়নি, তেমনি এ বিষয়ে মহামান্য হাইকোর্ট যে ১১টি নির্দেশনা দিয়েছেন তা বাস্তবায়নে কোন কোন প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে এখন অবধি কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কারখানায় হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠন করলেও তা বাস্তবে কার্যকর নয়।

সংবাদ সম্মেলনে আরও উল্লেখ করা হয়, সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে জেন্ডার প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ একটি পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে “কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইন ২০১৮” এর প্রস্তাবিত খসড়া তৈরী করে এবং একই বছর তা সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে দাখিল করেছে। এরপর অন্যান্য অনুরূপ সংস্থাও একই ধরনের খসড়া মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে, মন্ত্রণালয় সকল খসড়া একত্রিত করার জন্য জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে (এনএইচআরসি) দায়িত্ব অর্পণ করেছিল। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলির সাথে পরামর্শ করে একটি চ‚ড়ান্ত খসড়া তৈরি করেছে এবং তা বাংলাদেশ সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে এবং আইন,বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ২০২১-এর ডিসেম্বর মাসে জমা দিয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আইনটি পাশের জন্য এখনও মন্ত্রণালয় থেকে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। বিভিন্ন সময়ে প্রতিশ্রুতি দেওয়া স্বত্ত্বেও এখনও পর্যন্ত কাঙ্খিত আইনটি আলোর মুখ দেখেনি।সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য উদ্ধৃত করে উল্লেখ করা হয়, ২০২৪  সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে মোট ২১৯৭ নারী ও কন্যা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

শুধুমাত্র গত অক্টোবর মাসেই মোট ২০০ জন নারী ও কন্যা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩০ জন কন্যাসহ ৪৪ জন। তারমধ্যে ২ জন কন্যাসহ ৮ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে, ১ জন কন্যাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এছাড়াও ৭ জন কন্যাসহ ৯ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছেন। যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন ৭ জন কন্যাসহ ৯ জন। ২ জন কন্যাসহ ৪ জন উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছে।  এ ছাড়া আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এই দশ মাসে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮৩০ নারী। ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৩৯ নারী, আর এ কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৭ জন। এ ছাড়া আর ১৪১ নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে। বিলস এর সংবাদপত্রভিত্তিক জরিপ অনুযায়ী ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৭০ জন নারী শ্রমিক নির্যাতনের শিকার হন। এরমধ্যে কর্মস্থলে ২৫ জন এবং কর্মস্থলের বাহিরে ৪৫ জন নারী শ্রমিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

লিখিত বক্তব্যে আরও উল্লেখ করা হয়, এ পর্যন্ত বিশ্বের ৪৫টি দেশ ‘সহিংসতা ও হয়রানি সনদ-২০১৯ (আইএলও কনভেনশন-১৯০)’ অনুস্বাক্ষর করেছে এবং আশার বিষয় হচ্ছে বর্তমানে অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব সরকারের দ্রুততম সময়ের মধ্যে আইএলও কনভেনশন ১৯০ অনুস্বাক্ষরের উদ্যোগের প্রতিশ্রুতিতে এই আশার সঞ্চার হয়েছে যে, বর্তমান সরকার অতিদ্রুত আইএলও কনভেনশন ১৯০ অনুস্বাক্ষর করবেন । এতে উল্লেখ করা হয়, কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বন্ধে এই কনভেশনটি বাংলাদেশ কর্তৃক গৃহীত হলে তা বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতিকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেমন সুদৃঢ় করবে, তেমনি বাংলাদেশ সরকারের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল করবে। সেজন্য প্রয়োজন, এই কনভেনশনটি যথাযথ পর্যালোচনা করে অনুস্বাক্ষরের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

নারীর প্রতি হয়রানি ও নির্যাতন রোধে জেন্ডার প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ এর পক্ষ থেকে সরকারের কাছে যে সমস্ত দাবী তুলে ধরা হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, যৌন হয়রানিমুক্ত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে “কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন’ প্রণয়ন; কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা ও হয়রানি নিরসন বিষয়ক আইএলও কনভেনশন ১৯০ অনুসমর্থন; কর্মস্থলে যাতায়াতের পথে এবং সমাজে নারী শ্রমিকের যৌন হয়রানি থেকে সুরক্ষা প্রদান নিশ্চিত করতে ২০০৯ সালে প্রদানকৃত মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনার যথাযথ বাস্তবায়ন; সরকারি উদ্যোগে একটি তদারকি কমিটি গঠন; যৌন হয়রানি প্রতিরোধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতনের বিচার নিষ্পত্তি করা ও বৈষম্যমূলক আইন সংশোধন; বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা ২০১৫ এর সংশোধনীতে (১ সেপ্টেম্বর ২০২২ প্রকাশিত গেজেট) উল্লেখিত নারীর প্রতি আচরণ সংক্রান্ত নতুন বিধি ৩৬১ক এবং এই বিধির ৩৬১ক (২)’এ বর্ণিত অভিযোগ কমিটি গঠন প্রক্রিয়া মহামান্য হাইকোর্টের প্রদানকৃত নির্দেশনা-এর ভিত্তিতে করা এবং নারীর প্রতি সহিংসতামুক্ত সংস্কৃতি চর্চা অব্যবহত রাখা।

উল্লেখ্য,কর্মস্থল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সকল ধরনের সহিংসতা ও যৌন নির্যাতন প্রতিরোধের মাধ্যমে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ২০১৭ সালে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের মানবাধিকার/শ্রমিক সংগঠনগুলোর একটি সম্মিলিত প্ল্যাটফর্ম হিসেবে জেন্ডার প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে এই প্ল্যাটফর্মের সদস্য ১৪ টি সংগঠন, যার মধ্যে রয়েছে আওয়াজ ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিলস, বাংলাদেশ লেবার ফাউন্ডেশন-বিএলএফ, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি, এথিক্যাল ট্রেডিং ইনিসিয়েটিভ-ইটিআই, ফাউন্ডেশন ফর ল এন্ড ডেভেলপমেন্ট, ফেয়ার ওয়্যার ফাউন্ডেশন, ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিল-আইবিসি, কর্মজীবী নারী, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, মন্ডিয়াল এফএনভি, সলিডারিটি সেন্টার, সবুজের অভিযান ফাউন্ডেশন এবং দ্যা এশিয়া ফাউন্ডেশন । প্ল্যাটফর্মটি গঠনের পর থেকেই কর্মক্ষেত্রে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধের লক্ষ্যে বিগত ২০০৯ সালে মহামান্য হাইকোর্টের প্রদত্ত নির্দেশনা মেনে কারখানা/প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি মুক্ত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইন এর খসড়া প্রণয়ন এবং আইএলও কনভেনশন ১৯০ অনুসমর্থনের জন্য অব্যাহতভাবে কাজ করে যাচ্ছে।


Comments are closed.