শিরোনাম

গঙ্গা দেবীর উদ্দেশ্যে ফুল উৎসর্গ ও প্রাণের উৎসব ‘বৈসাবি’


জীতেন বড়–য়া,খাগড়াছড়িঃ নদীতে মা গঙ্গাদেবীর উদ্দেশ্যে ফুল দিয়ে পূজা করার মধ্যে দিয়ে চাকমা সম্প্রদায়ের ফুল বিজু শুরু ।শনিবার সকালে চেঙ্গী নদীতে ফুল নিবেদনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে চাকমাদের বিজুর মূল আনুষ্ঠাকিতা। এতে অংশ নিয়েছে হাজারো মানুষ। পাহাড়ের উৎসব সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আরো সুদৃঢ় হবে বলে মনে করছে অনেকেই। উৎসব ঘিরে নিরাপত্তা জোরদার করেছে পুলিশ। এদিকে বৈসাবির ফুল বিজুর সংবাদ সংগ্রহ ও ছবি তুলতে সাংবাদিকদের দুর্বৃত্তদের বাধা দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ফলে নির্ধারিত স্থানের বাইরে বিচ্ছিন্নভাবে ফুল ভানিয়েছে চাকমা সম্প্রদায়।

ফুল বিঝুকে কেন্দ্র করে আজ সকাল থেকে চেঙ্গী নদীর নির্বারিত স্থানে ফুল ভাসাতে নদীর তীরে তরুন-তরুনীদের নামে। উৎসব উপভোগ করতে সকালে চেঙ্গী নদীর পারে উপস্থিত হন খাগড়াছড়ি রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ মো: আমান হাসান, খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ওয়াদুদ ভূইয়া,জেলা প্রশাসক এবিএম ইফতেখারুল ইসলাম,পুলিশ সুপার মো: আরেফিন জুয়েলসহ সামরিক,রাজনৈতিক ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা।কিন্তু সকাল থেকে কিছু দুর্বৃত্ত সেখানে সাংবাদিকদের প্রবেশ বাধা দেয়। টাঙ্গানো হয় সাংবাদিক বর্জন সংক্রান্ত নানা ধরনের ব্যানার-ফেস্টুন। এমন পরিস্থিতিতে ফুল ভাসাতে লোকজন নির্ধারিত স্থানে ফুল না ভাসিয়ে বিছিন্নভাবে আনুষ্ঠিকতা পালন করেন।

এমন ঘটনাকে সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ অনাকাঙ্খিত বলে মন্তব্য করেছেন।

অপরদিকে তখনও ভালো করে আলো ফুটেনি। ফুটে উঠেনি সূর্যের পরিপূর্ণ রুপ। এরি মধ্যে ঐহিত্যবাহী পোশাকে সেজে নদীর পাড়ে আসতে শুরু করে তরুণ-তরুণীরা। ছোটরা এসেছে বাবা-মার হাত ধরে। বছরের গুরুত্বপূর্ণ ও আনন্দদায়ক দিন বলে কথা। বৈসাবির প্রথম দিনে চেঙ্গী নদীর পাড়ে ফুল দিয়ে পুজা করে পবিত্র হওয়ার মাধ্যমেই শুরু হয় বৈসাবির আনুষ্ঠানিকতা। চাকমা ও ত্রিপুরারা উৎসবের প্রথম দিনে বন পাহাড় থেকে সংগৃহিত ফুল দিয়ে ঘর সাজায়।সবার মঙ্গল কামনায় কলা পাতা করে ভক্তি শ্রদ্ধাভরে গঙ্গাদেবীর উদ্দ্যেশে ফুল উৎসর্গ করে পুরাতন বছরের অগনীত ভুলে নতুন বছরের শুভ কামনা করে। প্রত্যাশা করা হয় পাহাড়ে হানাহানি ভুলে সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে আসবে শান্তি ও সম্প্রীতি। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে গোটা পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিনত হয় সব সম্প্রদায়ের মানুষের মিলন মেলায়। এদিকে এই উৎসব দেখতে খাগড়াছড়িতে বেড়েছে পর্যটকের সংখ্যা। বলা যায় উৎসবে রঙ্গীন পার্বত্য চট্টগ্রাম।এই ধরণের উদ্যোগ পাহাড়ে সম্প্রীতি ও ঐক্যের বন্ধন সুদৃঢ় করবে বলে মন্তব্য করেছেন খাগড়াছড়ি ,জেলা প্রশাসক এবিএম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার ।

খাগড়াছড়ি পুলিশ সুপার মো: আরেফিন জুয়েল জানান বৈসাবি উৎসব ও বাংলা নববর্ষ ঘিরে পর্যটকে মুখর হবে খাগড়াছড়ি। তাই উৎসব ঘিরে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহন করেছে জেলা পুলিশ।

আঝ শনিবার চাকমা সম্প্রদায় ফুল বিজু পালন করছে। আগামীকাল শনিবার (১৩ এপ্রিল) মূল বিঝু আর পরের দিন রবিবার (১৪ এপ্রিল) পহেলা বৈশাখ বা গজ্জাপয্যা পালন করবে। এ সময় ঘরে ঘরে চলবে অতিথি আপ্যায়ন। একই সাথে শনিবার(১৩ এপ্রিল) ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের হারিবৈসু,বিযুমা,বিচিকাতাল।ফুল বিজু,মূলবিজু ও বিচিকাতাল নামে নিজস্ব বৈশিষ্টতায়। অপর দিকে রবিবার (১৪ এপ্রিল) খাগড়াছড়িতে মারমা স¤প্রদায় সাংগ্রাইং উৎসবে ঐতিহ্যবাহী জলকেলি বা পানি খেলা ও জেলা প্রশাসনে উদ্যোগে হবে বর্ষবরণের র‌্যালী।এ উৎসবে আনন্দের আমেজ ছড়ায়। চেঙ্গী নদীতে চাকমা সম্প্রদায়ের সাথে ফুল উৎসর্গদের সামিল হয়েছেন অন্য সম্প্রদায়ের মানুষও। বৈসাবি উৎসব দেখতে এসেছে অনেক পর্যটকও।

জানা যায়,ফুল বিঝু,হারি বৈসুর দিন ভোর থেকে বাড়ির পাশের নদী ও খালে গিয়ে প্রার্থনারত হয়ে পুরাতন বছরকে বিদায় জানায় ত্রিপুরা ও চাকমা সম্প্রদায়ের বিভিন্ন বয়সী নর-নারী। তবে এখন ফুল বিজু শুধুমাত্র চাকমা সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ নেই। মারমা ও স্থানীয় বাঙালীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা এসে অংশ নিচ্ছেন ফুলবিজু ও হারি বৈসুতে। ফুল নিবেদন শেষে তরুণ তরুণীরা মেতে ওঠেন আনন্দ উৎসবে। নদীতে স্নান শেষে বাড়ি গিয়ে বায়োজ্যেষ্ঠদের প্রণাম করে ছোটরা। ঘরবাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সাজসজ্জা শেষে প্রস্তুতি চলে অতিথি অ্যাপায়নের। ত্রিপুরা ও মারমা সম্প্রদায়ের চলছে বিভিন্ন গ্রামীণ খেলাধুলাও।

নদীতে ফুল দিতে আসা বিজয়া খীসা বলেন, পুরাতন বছরের দুঃখ জনিত ও পাপাচার থেকে মুক্তির জন্য দেবতার উদ্দেশে ফুল ভাসিয়ে পুরাতন বছরকে বিদায় জানালে নতুন বছর সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধির বার্তা দেবে।
উর্নিষা চাকমা বলেন,ফুল বিঝুর মধ্যদিয়ে আমরা পুরাতন বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নিচ্ছি। ফুল বিঝুর মধ্যদিয়ে আমাদের বৈসাবি উৎসবের সূচনা হয়েছে।

চট্টগ্রাম থেকে আসা মনিকা চন্দ বলেন,আমি পাহাড়ের ঐতিহ্যবাহী বৈসাবি উপলক্ষ্যে ত্রিপুরা ও চাকমাদের নদীতে ফুল নিবেদনের দৃশ্য স্বচক্ষে দেখার জন্য এসেছি। এমন কালারফুল অনুষ্ঠান দেখে খুবই ভালো লাগছে।

ঢাকা থেকে পর্যটক সীমা দাশ বলেন,আমি এতদূর থেকে খাগড়াছড়িতে আসছি পাহাড়ীরা নদীতে ফুল নিবেদনের এমন মনোরম দৃশ্য দেখার জন্য। আমি এমন অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পেরে সার্থক হলাম।আমি সত্যিই খুবই আনন্দিত।

স্থানীয় চাকমা তরুণী মমতা চাকমা বলেন, নদীতে ফুল নিবেদনের মধ্যদিয়ে আমরা স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করি যে,অতীতের সকল দুঃখ,কষ্ট মুছে, নতুন বছরে নতুনভাবে যেন সম্পূর্ণ সুস্থ্যভাবে জীবন যাপন করতে পারি।

এ ব্যাপারে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) রুমানা আক্তার বলেন,পাহাড়ের প্রধান সামাজিক উৎসব বৈসাবিতে চাকমাদের ফুল বিঝু উপলক্ষ্যে নদীতে ফুল দিয়ে সারিবদ্ধভাবে প্রণাম জানাচ্ছে। এমন দৃশ্য পাহাড়ের সৌন্দর্যকে আরও দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

বিশিষ্ট শিক্ষাবীদ প্রদীপ্ত খীসা বলেন,চাকমা সম্প্রদায় প্রতি বছর নদীতে ফুল দিয়ে প্রণাম জানাই অতীতের দুঃখ,গøানি দূর হওয়ার আশায়। নদীতে ফুল দিয়ে প্রণামের মধ্যদিয়ে আমাদের বৈসাবি উৎসব শুরু হয়েছে।

প্রসঙ্গত; ফুলবিঝুর দিনে ফুল দিয়ে ঘর সাজানোও একটা ঐতিহ্য। সাথে থাকে নিমপাতা। প্রতিটি বাড়িকে পরিষ্কার পরিছন্ন করে ফুলবিঝুর দিনে ঘর সাজানো হয়, বুদ্ধকে পুজো করা হয়। ফুলবিঝুর দিন ভোরে উঠে স্নান করার একটা রীতি প্রচলিত আছে। বিশ্বাস যে আগে স্নান করবে সে আগে বিজুগুলো পাবে। আসলে এটি বিজুর মত একটি সামাজিক উৎসবে ব্যক্তিগত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাকে উদ্বুদ্ধ করা হয়। এরপর চৈত্রমাসের শেষদিনকে চাকমারা বিজু বলে। মূলবিজুর দিনে নানা ধরণের খাবারে আয়োজন করা হয়। এবং বাড়ি বাড়ি গিযে ন্যুনতম সাত বাড়ির পাজন খাওয়ার রীতি প্রচলন আছে। আসলে এটা সামাজিকতার শিক্ষা দেয়।

বিঝুর দিনে প্রধান খাবার: পাজন, জগরা আর তরমুজ। বিঝুর দিনের মূল খাবার হলো পাজন। পাজন হলো বহু সবজি এবং শাক মিশ্রিত একটা খাবার। এই পাজনে সর্বনিম্ন ২২ থেকে সর্বোচ্চ ১১০ পদের সবজি মেশানো হয়। বিশ্বাস সারা বছর যেহেতু বিভিন্ন পদের খাবার খেয়ে বেঁচে থাকতে হবে তাই বছরের শেষদিন বিজুতে এসব তিতা, মিঠা খাবার খেয়ে শরীরে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করা।বিজুর দিনে পাজনে দেওয়ার জন্য আগের দিন’ই আম, কাঁঠাল পেরে রাখা হয়। এবং চাকমারা আম নিয়ে একটা ব্রত মানে সেটা হলো বিজুর আগে আম না খাওয়া। আসলে এর পেছেনে মূলত: দু’টো কারণ জড়িত। সাধারণত বিজুর আগে আম বড় হয় না/খাওয়ার উপযোগী হয় না। বিঝুর দিন পাজনে আম মিশিয়ে রান্না করা হয় এবং সেটা প্রথমে সাধারণত বুদ্ধকে দেওয়া হয় এবং বয়োজ্যোষ্ঠদের দেওয়া হয়। তাই বিঝুর আগে আম না খাওয়ার ব্রত মানে। গাছের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এর জন্য বিজুর দিন কোন ধরণের আম, কাঁঠাল পারা হয় না। ফুলবিঝু দিনের মতই বিজুর দিনও সবুজ গাছের নীচে বাতি জ্বালিয়ে গাছের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়। এবং পরের দিন নুও বজর। অর্থ্যাৎ নতুন বছর। চাকমারা এ দিনকে চাকমা ভাষায় গজ্জ্যেপজ্জ্যে দিন বলে। অর্থ্যাৎ অবসরের দিন এবং সেইসাথে নতুন করে উজ্জীবিত হওয়ার দিনও।

চাকমাদের কাছে এই দিনটির আলাদা একটা তাৎপর্য আছে। এদিনটি নতুন করে উজ্জীবিত হওয়ার দিন। চাকমাদের মধ্যে একটা বিশ্বাস প্রচলিত আছে- নতুন বছরে যা যা ভালো কাজ করবে সারাবছর সে সেইসব ভালো কাজেই থাকবে। তাই প্রতিটি চাকমা চায় এদিন ভালো কাজের সাথে সম্পৃক্ত থাকতে। এদিন তারা কোন ধরণের সহিংসতায় লিপ্ত হয় না। গৃহস্থরা ভোরে উঠে রান্নাবান্না করে এবং বিহারে পিন্ড দান করে। চাকমারা বিশ্বাস করে এদিন সারাদিন পূণ্যকাজে লিপ্ত থাকলে সারাবছর পূণ্যে/ভালো কাজে দিন কাটবে। গুরুজনদেরকে বাড়িতে এনে খাওয়ানো হয়। ফুলবিজু, মূল বিঝু এর মতই নতুন বছরেও সবুজ গাছের নীচে আর পানির উৎসে বাতি দেওয়া হয়। আর একদিন পরেই পাহাড়ে বিঝু উৎসব শুরু। সবার প্রাণে বিজুর আনন্দ ছুঁয়ে যাক। বিজুর তাৎপর্য সবাইকে উজ্জীবিত করুক ,বৈসাবি উৎসবের মধ্য দিয়ে পাহাড়ী-বাঙ্গালীর মধ্যে শান্তি-স¤প্রীতি ও ঐক্য আরো সু-দৃঢ় হোক এই প্রত্যাশা সকলের। পাশাপাশি বংশ পরম্পরায় পালিত এই উৎসবের সাথে আধুনিকতার ছোঁয়া আর বাংলা’র মিশেলে বৈসাবি হয়ে উঠেছে সর্বজনীন অন্য এক পাহাড়িয়া উৎসবে। উৎসবে সবার অংশগ্রহনে সাম্প্রাদায়িক সম্প্রীতি বৃদ্ধি পাবে; এমনটাই প্রত্যাশা স্থানীয়দের।

উল্লেখ্য ১৯৮৫ সাল থেকে খাগড়াছড়িসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত তিন স¤প্রদায়ের বিভিন্ন সংগঠনের সম্মিলিত উদ্যোগে ‘বৈসাবি’ নামে এ উসব পালন করে আসছে। যা সময়ের ব্যবধানে নিজ নিজ স¤প্রদায়ের লোকদের কাছে ‘বৈসাবি’ শব্দটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমা স¤প্রদায় তাদের নিজস্ব নামে ‘ত্রিপুরা ভাষায় বৈসু, মারমা ভাষায় সাংগ্রাই এবং চাকমা ভাষায় বিজু’ নামে এ উৎসব পালন হয়ে থাকে। এ তিন স¤প্রদায়ের নিজস্ব ভাষার নামের প্রথম অক্ষর নিয়ে ‘বৈসাবি’ নামকরণ করা হয়।

চাকমা,ত্রিপুরা ও মারমা সম্প্রদায়ের পাশিপাশি তঞ্চঙ্গ্যা,বম, খিয়াং, লুসাই, পাংখোয়া, ম্রো,খুমি,আসাম, চাক ও রাখাইনসহ ১৩ ক্ষুদ্র নৃ-জনগোষ্ঠী তাদের ভাষা-সংস্কুতি ও অবস্থানকে বৈচিত্রময় করে করে তুলতে প্রতি বছর চৈত্রের শেষ দিন থেকে ‘বৈসাবি’ উৎসব পালন করে থাকে।


0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments