হাফিজুল শরিফ, মাদারীপুর প্রতিনিধিঃ মাদারীপুরে মানবপাচার মামলার স্বাক্ষীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে ধর্ষণ মামলার আবেদন করা মানবপাচারকারী দালাল পারভীন বেগমকে (৪৭) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। রোববার (৬ এপ্রিল) রাতে এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রাজৈর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাসুদ খান। গ্রেপ্তারকৃত পারভীন জেলার রাজৈর উপজেলার শাখারপাড় গ্রামের রেজাউল মোল্লার স্ত্রী। তার বিরুদ্ধে একাধিক মানবপাচার মামলা রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, দালাল পারভীনের বিরুদ্ধে করা মানবপাচার মামলার স্বাক্ষী হওয়ায় তাদের উপর প্রতিশোধ নিতে মাদারীপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালতে মিথ্যা ধর্ষণ মামলার আবেদন করেছেন তিনি। ঘটনাটি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
ভুক্তভোগী পরিবার, এলাকাবাসী ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলার শাখারপাড় গ্রামের শাহ আলম মোল্লার ছেলে নূর আলম মোল্লাকে ১৫ লাখ টাকা চুক্তিতে ইতালি নেওয়ার প্রলোভন দেখায় পারভীন ও তার স্বামী রেজাউল মোল্লা। পরে গত ১৫ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে তার ছেলে সাকিব মোল্লার মাধ্যমে নূর আলমকে লিবিয়ার ত্রিপলিতে নিয়ে যায়। সেখানে আটকে রেখে নির্যাতন করে ধাপে ধাপে সর্বমোট ১৭ লাখ ৮ হাজার টাকা মুক্তিপন আদায় করে দালাল পারভীন ও তার চক্রের লোকজন। এরপর আরো মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টা চালালে বাংলাদেশ দূতাবাসের সাহায্যে মাফিয়াদের কাছ থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়। পরবর্তীতে গত ১৭ জুলাই ২০২৪ তারিখে নূর আলমকে আহত অবস্থায় দেশে পাঠায় দূতাবাসের কর্মকর্তারা। এ ঘটনায় ছেলের চিকিৎসা শেষে চলতি বছরের (২০২৫ সাল) ১৮ জানুয়ারি মাদারীপুর বিজ্ঞ মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন ট্রাইব্যুনাল আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন ভুক্তভোগীর মা রাশিদা বেগম। এ মামলায় পারভীন বেগমকে প্রধান আসামিসহ তার স্বামী রেজাউল মোল্লা(৫০), ছেলে সাকিব মোল্লা(২৬) ও আরেক মানবপাচারকারী শাহীন মিয়াকে আসামি করা হয়। খবর জানতে পেরে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান পারভীন ও তার স্বামী রেজাউল। এরই প্রতিশোধ নিতে ও মামলাটি ধামাচাপা দিতে গত ২০ মার্চ মানবপাচার মামলার ৩ ও ৪ নং স্বাক্ষী বখতিয়ার মোল্লা ও শাহ জালাল মোল্লাসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলার আবেদন করেন মানবপাচারকারী পারভীন। পরে রাজৈর থানার পুলিশ অভিযান চালিয়ে রোববার (৬ এপ্রিল) সকালে পারভীনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়।
এর আগে অপর এক ভুক্তভোগী গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার জলিরপাড় গ্রামের আলী শেখের স্ত্রী আচমিনা আক্তার (২৭) বাদি হয়ে মাদারীপুর আদালতে গত ১১ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে একই অভিযোগে মানবপাচারকারী পারভীন সহ ৪ জনকে আসামি করে মানবপাচার মামলা দায়ের করেন। তার বোন জামাই সাইদুর ও চাচা সবুজকে ইতালি নেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে লিবিয়ার মাফিয়া ঘরে আটকে রেখে নির্যাতন করে কয়েক ধাপে ৫৯ লাখ ২৫ হাজার টাকা মুক্তিপণ আদায় করেছে পারভীন চক্র।
এই দুইটি মামলার আসামিদের মধ্যে দালাল রাজৈর উপজেলার চানপট্টি গ্রামের সুমন খালাসী(৩০) লিবিয়া, শাহীন মিয়া লিবিয়া, সাকিব মোল্লা ইতালি এবং রেজাউল মোল্লা, খালেদা আক্তার খাফিজা(২০) ও উর্মি বেগম(২৫) বাংলাদেশে পলাতক রয়েছে।
এছাড়াও দালাল পারভীন বেগমের বিরুদ্ধে আরো কয়েকটি মামলা রয়েছে বলে জানা গেছে।
ভুক্তভোগী নূর আলম মোল্লার বোন ফাতেমা আক্তার বলেন, ১৫ লাখ টাকায় আমার ভাইকে ইতালি নেওয়ার কথা বলেছিল পারভীন দালাল। কিন্তু তার ছেলের মাধ্যমে লিবিয়ায় নিয়ে আটকে রেখে নির্যাতন চালিয়ে আমাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে ১৭ লাখ ৮ হাজার মুক্তিপণ নিয়েছে। তারপরও আমার ভাইকে মুক্তি দেয়নি তারা। একপর্যায়ে লিবিয়ার ত্রিপলিতে থাকা আমাদের পরিচিত লোকের মাধ্যমে দূতাবাসে খবর পাঠাই। পরে তারা পারভীনের মাফিয়াদের কাছ থেকে উদ্ধার করে ভাইকে দেশে পাঠিয়েছে। তারা এতো নির্যাতন করেছে যে, আমার ভাই এখন পর্যন্ত ঠিক মতো হাটতে পারে না। এ বিষয়ে মামলা করার আগে দালালরা আমাদের অনেক হুমকি দিছে। কারণ এলাকায় তারা অনেক প্রভাবশালী। মামলা ফেরাতে না পেরে প্রতিশোধ নিতে আমাদের মামলার দুই স্বাক্ষীসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা দিয়েছে। আমরা পারভীন সহ সকল দালালের কঠোর শাস্তি চাই।
মানবপাচার মামলার এক স্বাক্ষী শাহ জালাল মোল্লা বলেন, দালালের টাকা আমি নিজের হাত দিয়ে দিয়েছি। তাই আমি রাজ স্বাক্ষী। এছাড়া বখতিয়ার মোল্লাও দালালকে টাকা তার মাধ্যমে টাকা দিছে। আমাদের দুইজনের মাধ্যমেও যখন টাকা দেওয়া হয়েছে তাই আমরা স্বাক্ষী হয়েছি। কিন্তু পারভীন দালাল মামলাটা ধামাচাপা দিতে আমাদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা করেছে। কোর্ট থেকে পুলিশকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। অথচ পারভীন তার পরিবার সহ পলাতক ছিল, বাড়ি থাকতো না। তারপর ঘটনাস্থল দেখিয়েছে তার বাড়িতে।
এ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে রাজৈর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মাসুদ খান জানান, মানবপাচারকারী দালাল পারভীন বেগমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে একাধিক মানবপাচার মামলা রয়েছে।