গণঅভ্যুত্থানের ৬ মাসেও গ্রেফতার নাই॥ সাবেক এমপি মহিউদ্দিন ও তার পুত্র যুবলীগের সদস্য রিয়াদের।
মুন্সীগঞ্জে ডেভিল হান্টের কোন প্রভাব নেই। কোন গ্রেফতার অভিযানও লক্ষ্য করা যায় না। জামায়াত ও বিএনপিতে যোগদানের হিড়িক পড়ছে ফেসিষ্ট আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের। আওয়ামী লীগের শাসনামলে ছিলেন প্রভাবশালী নেতাদের মধ্যে অন্যতম একজন। দীর্ঘ ২৫ বছর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার ও ক্ষমতার শিংহাসনে বসে ছিলেন তিনি নিজেই।
গত ৫ আগষ্ট ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে সৈরাচার শেখ হাসিনার সরকারের পতন হলে ক্ষমতার মসনদ ভেঙে চুরমার হয়ে যায় তার। আত্নগোপনে চলে যান স্ব-পরিবারে। এক কালে হোটেলে ভাত আর চা বিক্রি করে চললেও রাজনীতির সোনার হরিন পেয়ে বনেছেন শত কোটি টাকার মালিক। আওয়ামী লীগ নেতার হাত ধরে আওয়ামী লীগে প্রবেশ করে সেই নেতাকেই আওয়ামী লীগ থেকে বিতারিত করে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ২৫ বছর ক্ষমতার সিংহাসনে বসে ছিলেন তিনি নিজেই। ক্ষমতায় বসে নানা অনিয়ম দূর্ণীতির মধ্য দিয়ে গড়েছের সম্পদের পাড়ার।
গত ৫ আগষ্টের পর আওয়ামী লীগ সরকারের একাধিক এমপি মন্ত্রী গ্রেফতার হলেও ছাত্রজনতার আন্দোলনে দমনপীড়ন ও ছাত্র হত্যার অভিযোগে দাযের করা হত্যা মামালার আসামী হয়েও ধরা ছোঁয়র বাইরে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মুন্সীগঞ্জ-১ আসনের সাংসদ ও সিরাজদিখানে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ। আওয়ামী লীগের শাসনামলে ৩৫ হাজার টাকা মাসিক বেতনে উপজেলা চেয়ারম্যানের চাকরি করা মহিউদ্দিন কি করে শত কোটি টাকার সম্পদ গড়লেন? অনুসন্ধান বলছে, কয়েক শত কোটি টাকার মালিক সাবেক এমপি মহিউদ্দিন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৯ সালে প্রথম বারের মত উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন মহিউদ্দিন। এর পর থেকে সিরাজদিখান উপজেলা চেয়ারম্যান চেয়ারে তিনি ছাড়া কেউই বসতে পারেন নি। একজন উপজেলা চেয়ারম্যানের মাসিক বেতন ৩০-৩৫ টাকা।৩৫ হাজার টাকা মাসিক বেতন হিসেবে ২০০৯ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত এ ১৫ বছরে তার সর্বো মোট বেতন দাড়ায় ৯৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। সারাজীনে যিনি সব মিলিয়ে ১ কোটি টাকা একত্রে করতে পারেন নি অথচ তার ছেলের একটি ডুপ্লেক্স বাড়ির দামই প্রায় আড়াই কোটি টাকার উপরে।
এছাড়া রিয়াদ যে গাড়ীতে চলাফেরা করেন চলেন, সেটির দামও ২৬ লাখ টাকা। ঢাকার ওয়ারিতে রয়েছে মহিউদ্দিনের একাধিক ফ্ল্যাট, কেরানীগঞ্জে একাধিক প্লট, শ্রীনগর ওয়াসা রোডের পাশে রয়েছে বিশাল আকারের জমি। নিমতলায় খাদ্য মোরকজাত এবং উতপাদনের একটি কারখানার মালিকানাসহ মহিউদ্দিন আহমেদ বিল্ডাস লিঃ, ঢাকা নিরাপদ হাউজিং লিঃ, অর্নিবান হাউজিং লিঃ ও বাংলা এশিয়া নিরাপদ হাউজিং লিঃ ৫ হাজার ৭ শ টি শেয়ারের মালিকানার তথ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনী হলফনামায় উল্লেখ করেছেন মহিউদ্দিন।
অনুসন্ধান অনুযায়ী মহিউদ্দিন তার নির্বাচনি হলফ নামায় যে অর্থ সম্পদের বিরণ দিয়েছেন তার সাথে মহিউদ্দিনের সম্পদের আকাশ পাতাল ব্যবধান রয়েছে। সিরাজদিখান ও শ্রীনগর উপজেলাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিজ পরিবারসহ নামে বেনামে অসংখ্য সম্পদ গড়েছেন তিনি। দেশ ছাড়াও ছোট ছেলে রিফাতের নামে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন মর্মে অভিযোগ রয়েছে আওয়ামী লীগের সাবেক প্রভাভশালী এমপি মহিউদ্দিনর বিরুদ্ধে। সিরাজদিখান উপজেলায় এক নায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা মহউদ্দিনের সহধর্মিণী সানজিদা আক্তার জোৎস্নার অবৈধ অর্থ সম্পদ উপার্জনের কাছে স্বামী মহিউদ্দিনকেও যেন হার মানিয়েছে।
মালখানগর ইউনিয়ন পরিষদের ২ বারের চেয়ারম্যান সানজিদা আক্তার জোৎস্নার সরকারী কাবিখা ১% তহবিলের প্রকল্প কাগজে কলমে বাস্তবায়ন দেখিয়ে প্রকল্পের কয়েক কোটি টাকা লোপাট করেছেন মর্মে তথ্য প্রমান মিলেছে। এমনকি ২০১০ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত কাবিখা এবং ১% (এক পার্সেন্ট) তহবিলের যে সকল প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে সে সকল প্রকল্পের ঠিকানা, বাজেট এবং ব্যায়ের হিসাব স্থানীয় এক সাংবাদিক একাধিকবার লিখি ভাবে চেয়েও পাননি।
ক্ষমতায় থেকে যেমন অবৈধ ভাবে অর্থ আর সম্পদের পাহার গড়েছেন তেমনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে মানুষের উপর জুলুম আর অত্যাচার চালিয়ে বছরের পর অসংখ্য মানুষকে হয়রানীও করেছেন এ মহিউদ্দিন। তার জুলুম অত্যাচার থেকে রেহাই পায়নি খোদ আপন ভাতিজা মামুনও। ক্ষমতা ধরে রাখতে একের পর এক মিথ্যা।
মামলায় জড়িয়ে বছরের পর বছর হয়রানী করেছেন তিনি। ওয়াজ মাহফিদলে ইসলামী এক বক্তার বক্তব্য আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যাওয়ায় মাহফিল শেষে ফেরার পথে ওই বক্তাকে পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার করিয়ে মামলা দিয়ে বছরের পর বছর হয়রানী করার নজিরও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সৈরাচার শেখ হাসিনার পিতা বাংলার বন্ধু খ্যাত শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ মুন্সীগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোঃ মহিউদ্দিনের ছত্রছায়ায় টিকে থাকা সিরাজদিখান উপজেলার মালখানগর ইউনিয়নের কাজিরবাগ গ্রামের মৃত আব্দুস সামাদ সরদারের ছেলে মহিউদ্দিনের ক্ষমতার মসনদ ভেঙে চুরমার হলেও প্রভাবশালী একটি মহলের দেওয়া কালো ছায়ায় নিজেকে ঢেকে রেখেছেন মহিউদ্দিন।
গত ৫ আগস্ট ছাত্রজণতার গণ অভ্যূত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলের প্রভাবশালী এমপি-মন্ত্রী থেকে শুরু করে গ্রেফতার হয়েছেন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী অঙ্গ সংগঠনের ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। তবে দেশের প্রায় সিংহভাগ জেলা ও উপজেলার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এমপি মন্ত্রী গ্রেফতার হলেও মুন্সীগঞ্জ-১ আসনের সাবেক এ সাংসদ মহিউদ্দিন আহমেদ ও তার পুত্র কেন্দ্রীয় যুবলীগের অন্যতম সদস্য আনিসুর রহমান রিয়াদকে গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
আওয়ামী লীগের এ এমপি ও তার পুত্রের বিরুদ্ধে ছাত্র হত্যা মামলাসহ ছাত্র জনতার আন্দোলনে সরাসরি দমন-পীড়ন চালানোর গুরুত্বর অভিযোগ থাকলেও তাদের আইনের আওতায় না আসা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহীনির ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সাধারণ মানুষ। সাবেক এমপি মহিউদ্দিন আহমেদকে বিএনপির সিনিয়র নেতা গোপনে তাকে ছায়া দিয়ে আসছেন মর্মেও অভিযোগ রয়েছে।
২৫ বছর আওয়ামী লীগের ক্ষমতার প্রভাব প্রতিপত্তির রাজ রাজত্বে বসে দলের নেতাকর্মীদের কাছে অর্থের বিনিময়ে পদ বানিজ্য, পালিত ক্যাডার বাহিনী দিয়ে। অন্যের জমি জবর দখল ও বিচার বানিজ্য এমনকি হত্যা মামলা নিয়েও বানিজ্য করেছে এ মহিউদ্দিন।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচন কিংবা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থীদের অর্থ খরচ হলেও মহিউদ্দিন ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে ৩ টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ইউপি চেয়ারম্যান ও দলীয় নেতাকর্মীদের বেধে দেওয়া অর্থে বিনা পয়সায় নির্বাচিত হয়েছেন।২০২৪ সালে অনুষ্ঠিতব্য সিরাজদিখান উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে লৌহজং উপজেলার বাসিন্দা আওলাদ হোসেন মৃধা নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৮ কোটি টাকা মনোয়ন বানিজ্যসহ নির্বাচনে জিতিয়ে দেওয়ার জন্য আরো কয়েক কোটি টাকা বানিজ্যের বিষয়টি সিরাজদিখান উপজেলার দলীয় নেতাকর্মী ও জনসাধারণের কাছে ওপেন সিকরেট।
ফুরশাইল গ্রামের আলোচিত তাপস হত্যা মামলার ৪ আসমামির মধ্যে ৩ আসামীকে রাজ স্বাক্ষী বানিয়ে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি পাইয়ে দিয়ে বাকী থাকা মামলার ১জন আসামীকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি পাইয়ে দেওয়ার জন্য দাবী করা ৯ লাখ টাকা আসামী পক্ষ চেকের মাধ্যমে দিতে চাওয়ায় গোড়াপিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ও আসামীকে ফাসির আসামী করে দেশ থেকে বিতারিত করেছেন এ মহিউদ্দিন।
এমনকি আসামীর পরিবারের আত্নীয় স্বজনদের আসামী পক্ষকে আইনি সহায়তা কিংবা আর্থিক সহায়তা যাতে না করে সে জন্য তাদের হুমকি দিয়ে আইনি সহায়তা পাওয়া থেকে আসামী পক্ষকে বঞ্চিত করেন তিনি। মানুষের উপর জোর জুলুম অন্যায় ভাবে অত্যাচার চালানো মহিউদ্দিনের ছেলে তার চেয়ে কোন অংশে কম নয়।
রাজকারের নাতিকে ছাত্রলীগের সভাপতির আসনে বসানোর সংবাদ প্রকাশ করায়, ছাত্রলীগের ক্যাডার বাহীনি দিয়ে স্থানীয় সাংবাদিকের মোহাম্মদ রোমান হাওলাদারের পকেটে গাজা ঢুকিয়ে দিয়ে হাত পা বেঁধে রেখে কয়েক ঘন্টা অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে তাকে পুলিশে দিয়ে হয়রানী করেন তিনি।
এদিকে গত জুলাই আগষ্ট মুন্সীগঞ্জ জেলায় ছাত্রজণতার আন্দোলনে একাধিক ছাত্র হত্যা ও আন্দোলনে নির্যাতন নিপীড়ন চালানোর অভিযোগে মুন্সীগঞ্জ সদর ও যাত্রাবাড়ী থানায় দায়ের হত্যা মামলার আসামী হয়েও সাবেক এমপি মহিউদ্দিন ও তার পুত্র রিয়াদ গ্রেফতার না হওয়ার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সিরাজদিখান উপজেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটি ও গণ অধিকার পরিষদের নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ।
এমপি মহিউদ্দিন ও তার পুত্র রিয়াদকে শেখ হাসিনার দোষর হিসেবে তাদের আখ্যা দিয়ে তাদের দ্রুত গ্রেফতার পূর্বক আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবী জানিয়েছেন তারা।
মহিউদ্দন আহমেদকে শেল্টার দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত মহিউদ্দিন আহমেদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু উপজেলা বিএনপির সাবেক আহবায়ক আব্দুল কুদ্দুস ধীরেনের কাছে জানতে চাইলে সরাসরি তাদের ছাফাই করে বলেন, এমপি মহিউদ্দিন অত্যন্ত ভালো লোক , আওয়ামীলীগ করলেই খারাপ না বলে জানান জেলার এই বিএনপি নেতা।
এব্যপারে সিরাজদিখান থানার ওসি খন্দকার হাফিজুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, থানা কার্যক্রম যদিও একটু কম তারপরও মহিউদ্দিন সাহেব ও তার পুত্র যুবলীগ সদস্য রিয়াদকে আটক করার প্রক্রিয়া আছি। তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে তাই তাদের আটক করতে আমরা সচেষ্ট আছি।
আজকেও আমাদের একটা টিম তাদের বিষয় কার্যক্রম পরিচালনা আছে। সংবাদ কর্মী প্রশ্ন ফ্যাসিবাদী এখনও প্রকাশ্যে ঘুরছে এমন কথার জবাবে ওসি সাহেব বলেন আমি তা জানি না, আর আমার পুলিশ কোন অনৈতিক কাজে নাই যে কোন সময় আটক হতে পারে , যেহেতু পিতা পুত্র দু জনের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা আছে।
মুন্সিগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার মুহম্মদ শামসুল আলম সরকার জানান, জেলা পুলিশ কাজ করছে , তবে অফিসে আসেন কথা বলি , অনেক সময় নিয়ে অনুসন্ধান করছেন , থানা পুলিশ কাজ করছেন বলে জানান মুন্সিগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার।
সকল জেলায় ডেভিল হান্টের গ্রেফতার অভিযান চলছে এবং গ্রেফতারও চলছে। কোন অজ্ঞাত কারণে মুন্সীগঞ্জের কোন থানায়ই ডেভিল হান্টের গ্রেফতার পরিলক্ষিত হচ্ছেনা তা জানতে চায় সাধারণ জনগণ।